বারো মাস ফল উৎপাদন


 যদি ভালো থাকতে চাই রোজ আমাদের প্রত্যেকের অন্তত একটি ফল খেতে হবে। সেটা কলা হোক আর আমই হোক। আমাদের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য যেসব অনুখাদ্য উপাদান বিশেষ করে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের দরকার হয় তার একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস হলো ফল অথবা শাকসবজি। একেক ফলে রয়েছে একেক উপাদান।  সেজন্য বিদেশিরা কখন একটি মাত্র ফল খায় না, একাধিক ফল টুকরো করে কেটে একবারে মিশিয়ে তা খায়। হিন্দুধর্মে দেব-দেবীর পূজার অর্ঘ্য হিসেবে পঞ্চ ফল নিবেদন করেন। এর অর্থ দেব-দেবীরাও পাঁচ রকম ফল পেলে তুষ্ট থাকেন। একেক দেবতার আবার একেক ফলে বিশেষ তুষ্টি আসে। যেমন বেল ছাড়া শিব পূজা চলে না, মঙ্গল ঘটে ডাব ছাড়া কোনো পূজাই হয় না। ডাব তথা নারিকেল হলো জীবন রক্ষাকারী ফল। কেননা, ডাবের পানিতে যথেষ্ট সোডিয়াম রয়েছে যা আমাদের সংবেদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ঘাটতি হলেই সাড়া ঠিকমতো মস্তিষ্কে পৌঁছায় না, আমরা কোনো কিছুতে ঠিকমতো সাড়া দিতে পারি না, ভুলে যাই, অবসতা চলে আসে, এমনকি মানুষ কোমায় পর্যন্ত চলে যায়। যেটাকে অনেক সময় স্ট্রোক বলে ভুল করি। কাজেই দেহকে সচল ও সবল রাখতে হলে প্রতিদিন ফল খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বারো মাসের ৩৬৫ দিনের রোজ যে ফল খাব, পাব কোথায়? রোজ রোজ কি ফলই বা খাব? বাজার থেকে যেসব ফল কিনে খাচ্ছি, সেসব ফল দেহের জন্য কতটা নিরাপদ? তাহলে করবটা কি?

রোজ ফল খাবো কেন?
দেহ সুস্থ-সবল রাখতে যেসব পুষ্টি উপাদানের দরকার তার প্রায় সবই ফলে আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের আধার হলো ফল। ফল পটাশিয়ামের একটি উত্তম উৎস যা সচরাচর অন্য খাদ্যে কম পাওয়া যায়। পটাশিয়াম কিডনিতে পাথর হওয়া ও হাঁড় ক্ষয় কমায়। ফলের ফলিক এসিড রক্তকণা গঠনে সাহায্য করে। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষায় ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে ফল অদ্বিতীয়। তাদের দেহের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ফলেট বা ফলিক এসিড দরকার হয়। প্রতিদিন ফল খেলে স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। কিছু কিছু ফল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

রোজ কতটুকু ফল খেতে হবে?
রোজ অন্তত একটা হলেও ফল খেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এটা একদম সত্যি কথা। চিকিৎসকরা রোজ একজন ব্যক্তিকে তার দেহের ওজন অনুসারে প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য দিনে ০.৮ গ্রাম ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পুষ্টিবিদদের মতে, রোজ একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের কমপক্ষে ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। তার মানে পাঁচজনের একটি পরিবারে রোজ ১ কেজি ফল লাগবে। এ পরিমাণ কলা, পেঁপে, কুল, আম ইত্যাদি ফল পাওয়া সম্ভব। দেশীয় ফলের মতো পুষ্টিকর ও সস্তা ফল আর হয় না। কিন্তু রোজ ২০০ গ্রাম ফল যে খাবো তা জোগাবে কে? এ দেশে বর্তমান ফলের যে উৎপাদন তা আমাদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। তাই বিদেশ থেকে আঙুর, আপেল, কমলা, নাশপাতির মতো অনেক ফলে এখন দেশের বাজার ভরে গেছে। বেশি দাম দিয়ে কেনা সেসব ফল থেকে কিন্তু আমরা খুব কম পুষ্টিই পাই। আর সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এসব ফল আমরা যখন বাজার থেকে কিনি তা কখনই টাটকা থাকে না, অনেক দিন আগে গাছ থেকে পেড়ে নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দেশের বাজারে আসে। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর থেকেই পুষ্টি কমতে থাকে, পুষ্টি উপাদানের পরিবর্তন হতে থাকে। তাছাড়া বেশির ভাগ ফলই বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয় যাতে ফল না পচে। এজন্য এসব ফল দেহের জন্য ততটা নিরাপদ ও পুষ্টিকর নয়।
অতীতে একটা কথা চালু ছিল, ‘যদি বাঁচতে চাও, যত পার সবজি আর ফল খাও’। কিন্তু এই যত পার মানে কি? পর্যাপ্ত ফল বলতে কি রোজ দশটা আম, কুড়িটা কুল না পাঁচ ঝুড়ি ফল খাবো? এ পরিমাণের কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না। রোজ কে কতটুকু ফল খাবে তা আসলে লিঙ্গ, বয়স, কাজের ধরন ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যারা দৈহিক পরিশ্রম কম করেন, তাদের জন্য ফল খাওয়ার পরিমাণ হবে এক রকম, যারা বেশি করেন তাদের জন্য ফল খাওয়ার পরিমাণ হবে আর এক রকম।

রোজ রোজ ফল পাবো কোথায়?

রোজ ফল খেতে হবে ভালো কথা। কিন্তু তা পাবো কোথায়? সহজ উত্তর হলো, বাজার থেকে কিনে খাবো। বাজারে প্রায় সব সময় বিদেশি ফল পাওয়া যায়, কিন্তু দেশি ফল পাওয়া যায় না। কেননা, যেসব ফল এ দেশে উৎপন্ন হয় তার উৎপাদনও সারা বছর ধরে সুষমভাবে বণ্টিত নয়। এ দেশে যত ফল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর, এ ৪ মাসের মধ্যে। অর্থাৎ গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল হলো এ দেশে ফলের রাজমৌসুম। তাহলে বাকি ৮ মাস আমাদের চলবে কি করে? এজন্য পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য হলেও প্রতিটি বসতবাড়িতে এমনভাবে পরিকল্পনা করে ফলগাছ লাগতে হবে, যা থেকে আমরা সারা বছর, মাসের ৩০টা দিন ফল পেতে পারি। পারলে গোটা পাড়া বা গ্রামকে এ পরিকল্পনার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। এতে সুবিধা হবে, পাড়া বা গ্রামের কোনো না কোনো বাড়িতে রোজ কিছু না কিছু ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যেসব বাড়ির ফলবাগান থেকে যেদিন কোনো ফল পাওয়া যাবে না তারা ও সব বাড়ি থেকে সংগৃহীত ফল পাড়া বা গ্রামের নিজেরা কিনে খেতে পারবে। এতে প্রতিটি বাড়িতে রোজ ফল খাওয়ার অভ্যেস গড়ে উঠবে, নিরাপদ ফল পাওয়া সম্ভব হবে ও উৎপাদিত ফল বিক্রি কোনো সমস্যা হবে না।

বারো মাসের ফল
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল জন্মে এ দেশে। এর মধ্যে ৬০টি হলো বুনো ফল, বনে জন্মে। প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ ফল উৎপাদিত হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে। ফলের প্রধান উৎপাদন মাস হলো জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস। বেশি উৎপাদনের কারণে একদিকে ফলের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। মানুষ কম দামে বেশি ফল কিনতে পারে। এজন্য খুশি থাকে। কিন্তু উৎপাদনকারী চাষিদের মনে সুখ কম থাকে কম দামের কারণে। এ দুই মাস বেশি ফল খেতে পারলেও বাকি দশ মাসে ফল কমে যায়। শীতকালে কমলা আর কুল ছাড়া অন্য ফল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। অবশ্য কলা ও পেঁপে বারো মাসই উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি গবেষণার সুবাদে এখনে বছরে সাত মাস আম পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি তথা হরমোন ব্যবস্থা করে বারো মাস এখন আনারস উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। প্রধান উৎপাদন মৌসুমের বাইরে অন্যান্য মৌসুমে বা মাসে ফল উৎপাদন করতে পারলে তা ফলের বাড়তি উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষকদের অধিক লাভবান করতে পারে। বারো মাস থাই পেয়ারা উৎপাদন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এজন্য ফল চাষি ও বাড়ির গৃহস্থদের একটু পরিকল্পনা করে ফল চাষ শুরু করতে হবে যাতে বারো মাসই সেখান থেকে কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। একই ফলের বিভিন্ন জাত লাগিয়েও কয়েক মাস ধরে ফল পাওয়া যায়। যেমনÑ পরিকল্পনা করে বিভিন্ন জাতের আম লাগিয়ে বছরের প্রায় সাত মাস ধরে আম পাওয়া যায়। কোন মাসে কোন ফল উৎপাদন করা সম্ভব তা তালিকা-১ এ উল্লেখ করা হলো।

বারো মাসের বারোটি ফলের গাছ নির্বাচন

বসতবাড়ির আঙিনায় থাকুক অন্তত বারো মাসের বারোটি ফলের গাছ। এজন্য প্রথমে পরিকল্পনা করতে হবে। তালিকা ১ থেকে বেছে নিতে হবে পছন্দের ফলের গাছ। বাড়িতে যেসব ফলের গাছ আছে সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। ওপরের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে বাড়িতে থাকা সেসব ফলের গাছ থেকে কোন কোন মাসে ফল পাওয়া যায়।  যেসব মাসে বাড়ির বাগান থেকে কোনো ফল পাওয়া যায় না সেসব মাসে ফলের প্রাপ্যতা ও পছন্দ অনুসারে ফলগাছ বেছে নিতে হবে। ফলগাছ নির্বাচনের সময় অবশ্যই কৃষি জলবায়ু অর্থাৎ বাড়ির অঞ্চলে কোন কোন ফলের গাছ ভালো হয়, সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। যেমন- উপকূলীয় অঞ্চলে ভালো হয় নারিকেল, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, সফেদা, চালতা, কদবেল, অরবরই, আমড়া, চুকুর, ক্ষুদিজাম, তরমুজ, আমরুল, বিলাতি গাব, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, কেওড়া, গোলফল, তাল, পানিফল, বৈঁচি, তেঁতুল ইত্যাদি। উত্তরাঞ্চলে ভালো হয় আম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, আলুবোখারা, পিচফল ইত্যাদি। মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ভালো হয় আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, কলা, বেল, আনারস, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, খেজুর, ডেউয়া, চালতা, জলপাই, পানিফল, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি। পূর্বাঞ্চলে ভালো হয় আনারস, লেবু, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, ডেফল, তৈকর, ডেউয়া, কুল, কামরাঙা, অরবরই, বিলিম্বি ইত্যাদি। পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো হয় আনারস, কাঁঠাল, মাল্টা, আ¤্রপালি ও রাঙ্গোয়াই আম, বিলিম্বি, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, লুকলুকি, গুটগুইট্টা, চুকুর বা আমিলা, চিনার, মারফা, বেল, মাল্টা, কমলালেবু, লেবু, তেঁতুল ইত্যাদি। এসব ফলের মধ্য থেকে সাধারণভাবে বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য মাল্টা (জানুয়ারি), কুল (ফেব্রুয়ারি), বেল (মার্চ), তরমুজ (এপ্রিল), জাম (মে), আম, লিচু (জুন), কাঁঠাল (জুলাই), পেয়ারা (আগস্ট), আমড়া (সেপ্টেম্বর), জলপাই (অক্টোবর), ডালিম (নভেম্বর), কমলালেবু (ডিসেম্বর) নির্বাচন করা যেতে পারে। বছরের যে কোনো সময় ফল পাওয়ার জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে নারিকেল, পেঁপে, কলা, আনারস, সফেদা ইত্যাদি ফল। এখন পেয়ারাও বারোমাস ধরছে। জাত বুঝে গাছ লাগাতে পারলে আমও ৭ মাস ধরে পাওয়া সম্ভব।

বারো মাস ফলের উৎপাদন কৌশল

পরিকল্পনা করে ফলগাছ অবশ্যই লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে আধুনিক চাষাবাদের সব নিয়ম মানতে হবে। বসতবাড়িতে নিরাপদ ফল উৎপাদনের সব প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে জৈব সার ব্যবহার, সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, বালাইনাশক ও পাকানোর জন্য কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করা ইত্যাদি অন্যতম। তালিকা ২-এ সংক্ষেপে বারো মাসে বারোটি ফলের উৎপাদন কলাকৌশল দেয়া হলো।
তালিকা-২ : বারো মাসের প্রধান ১৫টি ফলের উৎপাদন প্রযুক্তি
বড় আকৃতিবিশিষ্ট গাছের (আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি)  জন্য সবদিকে ১ মিটার মাপের গর্ত তৈরি করতে হবে। মধ্যম আকৃতির গাছের (কুল, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি) জন্য সবদিকে ৬০-৭৫ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত করতে হবে। ছোট গাছের জন্য (কলা, পেঁপে, ডালিম ইত্যাদি) সবদিকে ৫০ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত করতে হবে।
চারা বা কলম লাগানোর কমপক্ষে ১৫ দিন আগে গর্ত করতে হবে। গর্তের মাটির সঙ্গে পরিমাণমতো গোবর সার ও অন্যান্য সার মিশিয়ে গর্ত ভরতে হবে। গর্তের মাঝখানে চারা কলম লাগিয়ে গোড়ার মাটি ভালো করে চেপে দিতে হবে। কাঠি পুঁতে ও ঘেরা দিয়ে চারা রক্ষা করতে হবে। লাগানোর পর সেচ দিতে হবে। নিচের ছকে উল্লেখিত পরিমাণে সার দিতে হবে। বছরে দুইবার সার দিতে হবে- বর্ষার আগে একবার ও বর্ষাকালের পরে আর একবার সার দিতে হবে। প্রতি বছর গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ঠিকমতো ডালপালা ছাঁটাই ও বালাই ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

Thank you for see this post..

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post